চর্যাপদ —বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন

আবিষ্কার : বাংলা ভাষার প্রাচীনতম গ্রন্থের নাম 'চর্যাপদ' বা 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়'। তালপাতায় লেখা এই বৃহৎ পুথিটির আবিষ্কারক মহামহোপাধ্যায় পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়। তিনি ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে নেপালে যান এবং সেখানকার রাজদরবারের গ্রন্থশালা থেকে খন্ডিত, কীটদষ্ট এই গ্রন্থটি আবিষ্কার করেন। এতে ছিল   ৪৬ টি সম্পূর্ণ পদ  এবং একটি আংশিক পদ।হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় নেপালের পুথি সংগ্রহশালা থেকে তিনটি দোঁহাগ্রন্থের সঙ্গে এই গ্রন্থটি আবিষ্কার করেন। এই গ্রন্থটির সঙ্গে টীকাকার মুনি দত্তের সংস্কৃত টীকা ছিল।   এই টীকার সাহায্যে পরবর্তী সময়ে রহস্যময় ভাষায় লেখা পদগুলির গূঢ়ার্থ উদ্ধার কিছুটা সহজ হয়েছিল। 
চর্যাপদের মূল সংকলনের তিব্বতীতে অনুবাদ করেন শীলচারী। শীলচারী চর্যা ও মূল চর্যাকে সামনে রেখে মুনি দত্ত সংস্কৃততে ৫০ টি টীকা ব্যাখ্যা করেন । শাস্ত্রী মহাশয় নেপালে গিয়ে মুনিদত্তের টিকা ও মূল চর্যাকে নিয়ে আসেন।মূল গ্রন্থটি যথা সময়ে ফেরত দিয়ে দেন। (শীলচারী ও মুনি দত্ত বন্ধুভাবাপন্ন ব্যক্তি যারা নেপালের রাজদরবারের থাকতেন।)

নামকরণ : 
'বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ' থেকে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় এর সম্পাদনায় ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে চর্যার এই পদগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় । শাস্ত্রী মহাশয় এই গ্রন্থটির নামকরণ করেন 'হাজার বছরের পুরনো বাংলা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা।' এতে শুধু চর্যার পদগুলি নয়, আরও সংযোজিত হয়েছে 'সরহাচার্যের দোহা', 'কৃষ্ণাচর্যের দোহা'এবং 'ডাকার্নব' ।মুখবন্ধে শাস্ত্রী মহাশয় নিজেই লিখেছেন যে এই সব গুলো প্রাচীন বাংলায় লেখা।

রচনাকাল:
চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে মতভেদ আছে। কেউ কেউ বলেন চর্যাপদের রচনাকাল অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী, আবার কেউ কেউ মনে করেন দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী। যদিও গ্রহণযোগ্য মতবাদ হল দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী। এই সময় বাংলাভাষা সবে মাত্র মাগধী অপভ্রংশ -এর খোলস ছেড়ে আত্মপ্রকাশ করছে। 
'চর্যাপদ' নেপাল থেকে আবিষ্কারের কারণ :  বাংলার রাজনীতিতে পালযুগের অবসান হয়ে সেনযুগের সূচনা হয়েছে। পালযুগ ছিল বৌদ্ধ যুগ কিন্তু সেনযুগ ব্রাহ্মণ্যবাদের যুগ। পালযুগে বৌদ্ধ ধর্ম রাজধর্ম হওয়ার সুবাদে প্রসার লাভ করেছিল ঠিকই কিন্তু এই যুগে কোন ধর্মিয় গোড়ামি ছিল না। সেন যুগে অন্য ধর্মের প্রতি অগ্রাসন তীব্র আকার ধারণ করলে নিজেদের উপর সংকট অসতে পারে ভেবে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা পালিয়ে যেতে শুরু করল নেপালে, যেখানে তাদের সধর্মের লোকেরা রয়েছে।
পরবর্তী কালে তুর্কি আক্রমণের পর  বাংলাদেশে অরাজকতা দেখা দিলে আবারও তারা পালিয়ে যেতে শুরু করল নেপালে। যাবার সময় সঙ্গে করে নিয়েছিল তাদের গ্রন্থ গুলো। সম্ভবত এই জন্যেই 'চর্যাপদ' নেপাল থেকে পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের আদ্র জলবায়ু পুথিটি উপকরণ যা দিয়ে তৈরি তা সংরক্ষণের অনূপযোগী ।সম্ভবত এই জন্যেই পুথিটি বাংলাদেশে পাওয়া যায়নি।
গ্রন্থ পরিচয়:
উজ্জ্বল কালো কালিতে লেখা তালপাতার এই পুথিটির প্রতিটি পাতায় ৫টি করে চরণ আছে, শুধু মাত্র একটি পাতায় ৬টি চরণ আছে।
 পুথিঁর মধ্যেকার কয়েকটি পাতা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ২৩ সংখ্যক পদের শেষাংশ এবং ২৪,২৫,ও ৪৮ সংখ্যা পদ পাওয়া যায়নি।অর্থাৎ সারে ছেঁচল্লিশটি পদ পাওয়া গিয়েছে।  মুনি দত্ত ৫০টি পদের ব্যাখ্যা করেছিলেন। পরবর্তীকালে ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী চর্যাপদের তিব্বতী অনুবাদ গ্রন্থ থেকে মুনি দত্তের বাদ দেওয়া পদটির পরিচয় উদ্ধার করেন। এর ফলে নিশ্চিত হওয়া যায় যে চর্যাপদের মোট ৫১টি পদ ছিল।

চর্যার কবি:
মূল পুথিঁটির সারে ছেঁচল্লিশটি পদের প্রতিটি পদেই পদকর্তার নাম আছে –কোথাও ভনিতা রুপে আবার কোথাও পদগানের প্রারম্ভে কবিনাম নির্দেশিকা রুপে। ২৪,২৫,৪৮ সংখ্যক পদ লুপ্ত ; তবে টীকা থেকে ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক পদগানের রচইতার নাম পাওয়া যায়। আর তিব্বতী অনুবাদ থেকে জানা যায় ২৪ সংখ্যক পদগানের রচইতার নাম। এই নামগুলির অধিকাংশই তাদের ছদ্মনাম। নামের শেষে 'পা' অর্থাৎ 'পাদ' শব্দটি সম্মান সূচক উপাধি হিসাবে ব্যবহার করতেন। চর্যাপদের সাধক কবিরা প্রত্যেকেই ছিলেন সিদ্ধ আচার্য। পদকর্তার নাম ও তাদের রচিত পদ সংখ্যা –
(ক) লুইপা  – ১,২৯  নং পদ (প্রথম পদকর্তা)
(খ) কুক্করীপা– ২, ২০, ৪৮  নং পদ
(গ) বিরুপা  – ৩   নং পদ
(ঘ) গুন্ডরীপা– ৪   নং পদ
(ঙ)চাটিল্লাপা– ৫  নং পদ
(চ) ভুসুকপা –৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০ ,৪১, ৪৩, ৪৯নং পদ           (দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদকর্তা, পদ সংখ্যা ৮টি)
(ছ) কাহ্নপা – ৭, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ২৪, ৩৬, ৪০, ৪২, ৪৫ নং পদ (সর্বোচ্চ পদকর্তা, পদ সংখ্যা ১৩টি)
(জ) কাম্বালম্বপা– ৮ নং পদ 
(ঝ) ডোম্বীপা – ১৪ নং পদ 
(ঞ)  শান্তিপা – ১৫, ২৬ নং পদ
(ট) মহীধর পা – ১৬  নং পদ 
( ঠ)   বীণাপা  – ১৭  নং পদ 
(ড)   সরহপা  – ২২, ৩২, ৩৮, ৩৯ নং পদ 
(ঢ)  শবরপা  – ২৮, ৫০, নং পদ 
(ণ)আর্যদেবপা– ৩১  নং পদ 
(ত)  ঢেন্ডনপা – ৩৩ নং পদ 
(থ) দারিকপা বা দাড়িম্বপা – ৩৪ নং পা 
(দ) ভাদেপা– ৩৫ নং পদ 
(ধ) তাড়কপা  – ৩৭ নং পদ 
(ন)  কঙ্কণপা – ৪৪ নং পদ 
(প)জয়নন্দীপা –৪৬ নং পদ 
(ফ)   ধর্মপা –  ৪৪ নং পদ 
(ব) তন্ত্রীপা – ২৫ নং পদ 

মোট ২৪ জন পদকর্তার মধ্যে ২৩ জন পদকর্তার পদ পাওয়া গিয়েছে । লাড়ীডোম্বীপা -এর পদ পাওয়া যায়নি। 

চর্যার ভাষা :
চর্যাপদের ভাষারীতি রহস্যময়। গ্রন্থটি নেওয়ারী অক্ষরে বাংলা ভাষায় রচিত হলেও আধুনিক বাংলা ভাষার সঙ্গে এর মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। চর্যাপদের ভাষাতত্ত্ব আলোচনা করে প্রখ্যাত ভাষাবিদ্ ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ পন্ডিতগণ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, এর রচনাকাল দশম-দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে। এই সময় বাংলাভাষা সবে মাত্র মাগধী-অপভ্রংশ এর খোলস ছেড়ে আত্মপ্রকাশ করছে । চর্যার সিদ্ধাচার্যগণ এই মুহূর্তে অপরিণত বাংলা ভাষায় সহজপন্থীদের জন্য পদ রচনা করেছেন। এই সময় শৌরসেনী-অপভ্রংশ ছিল সর্বভারতীয় গণ-সাহিত্য রচনার সাধারণ মাধ্যম।স্বাভাবিক ভাবেই চর্যাপদের ভাষাতেও শৌরসেনী-প্রাকৃত ও অপভ্রংশ -এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তাই কেউ কেউ চর্যাপদকে বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন বলে অস্বীকার করেছেন। ড.সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর –'The origin and Development of the Bengali language' বই তে প্রমাণ করেন যে, চর্যাপদের ভাষা বাংলা। 
বাংলা ভাষায় রচিত হলেও চর্যাপদ পড়ে এর প্রকৃত অর্থ বোঝা যায় না।এই জন্যেই চর্যাপদের ভাষাকে টীকাকার মুনি দত্ত 'সন্ধ্যা ভাষা' ও 'সন্ধা ভাষা' নামে অভিহিত করেছেন। তিনি 'সন্ধ্যা' ও 'সন্ধা' দুটো শব্দেরই ব্যবহার করেছেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় চর্যাপদের ভাষার ক্ষেত্রে 'সন্ধ্যা ভাষা' কথাটি ব্যবহার করেছেন। তাঁর মতে evening অর্থে 'সন্ধ্যা' কথাটা ব্যবহৃত হয়েছে। চর্যাপদের ভাষা কিছু বোঝা যায়, কিছু বোঝা যায় না। হেঁয়ালি এই ভাষার কতক আলো –কতক অন্ধকার। ভাষার এই আলো-আঁধারী রুপের জন্যই একে 'সন্ধ্যা ভাষা' বলা হয়েছে ।
ভাষাতাত্ত্বীক প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও বিধুশেখর শাস্ত্রী একে য - ফলাবিহীন 'সন্ধা ভাষা' বলে উল্লেখ করেছেন। 'সন্ধা' শব্দটি সম এবং ধ্যৈ ধাতু থেকে এসেছে, যার অর্থ – সম্যকরূপে ধ্যান করে বোঝা।
সুকুমার সেন তাঁর 'চর্যাগীতি পদাবলী' বইতে 'সন্ধ্যা ' ও 'সন্ধা' এই দু'রকম বানানের ব্যুৎপত্তি নিয়েই আলোচনা করেছেন। তিনি ' আলো-আঁধারী ভাষা ' এই অর্থ নেননি। তাঁর মতে 'সন্ধ্যা ' অথবা 'সন্ধা ' শব্দটিতে প্রকট রয়েছে ধ্যৈ ( ধা) ধাতুর অর্থ। অর্থাৎ যে ভাষায় বা শব্দে অর্থ বিশেষ ভাবে নিহিত (সম্ +ধ্যৈ বা ধা) তাই 'সন্ধ্যা' অথবা ' সন্ধা' ভাষা। 
মুনি দত্তের টীকা পাওয়া না গেলে দুর্বোধ্য-রহস্যময় হেঁয়ালি এই ভাষার মর্মার্থ দুর্বোধ্যই থেকে যেত। পদগুলির ভাষা এতটাই রহস্যময় যে এর সাধারণ অর্থের থেকে গূঢ়ার্থ আলাদা। কুক্করীপা -এর দ্বিতীয় সংখ্যক পদ এই ভাষার প্রকৃষ্ট নিদর্শন তুলে ধরেছে। 
     "দিবসই বহুড়ীকাড়ই ভরে ভা অ। 
      রাতি ঙইলে কামরু জা অ।।" 
সাধারণ অর্থ : এই দিবসে বধূ কাকের ডাককে ভয় পাচ্ছে আর রাত হলে কাম সেবার্থে যাচ্ছে। 
গূঢ়ার্থ : চিত্তের প্রবৃত্তিময় অবস্থায় অবধূতিকা (সন্ন্যাসিনী) ভীত হয়, কিন্তু চিত্তের নিবৃতিময় অবস্থায় অবধূতিকা মহাসুখ চক্রে উন্নীত হয়। 
বৌদ্ধ সহজিয়াদের গূঢ় ধর্মাচার -কে অবৌদ্ধদের দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রাখার জন্য এই ভাষার সৃষ্টি হয়েছিল। 

   


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'হাজার চুরাশির মা' ও মহাশ্বেতা দেবী

বাউল শব্দের উৎপত্তি ও বাউল মতবাদ বা দর্শন_বাউল সাধনসংগীত বাউল গান