বাউল শব্দের উৎপত্তি ও বাউল মতবাদ বা দর্শন_বাউল সাধনসংগীত বাউল গান
বাউল শব্দের উৎপত্তি ও বাউল দর্শন :সংস্কৃত 'বাতুল'(উন্মাদ, পাগল, ক্ষেপা, ছন্নছাড়া, উদাসী) শব্দ থেকে 'বাউল' শব্দের উৎপত্তি। আরবি শব্দ 'আউল' এবং হিন্দি শব্দ 'বাউর' এর অর্থ 'বায়ু রোগ গ্রন্থ'। বায়ু অর্থাৎ স্নায়ুপ্রবাহ। কিন্তু বাউল সম্প্রদায়ের পরিচয় দিতে গিয়ে 'বিশ্বকোষ' -এ উল্লেখ করা হয়েছে "বাতুলের ন্যায় এই সম্প্রদায়ের লোকেরা ছিন্ন বস্ত্রখন্ড সংযোজিত করিয়া পরিধান করিয়া থাকে। বর্তমানে আমরা শখের যে পেশাদারী বাউল সম্প্রদায় দেখিতে পাই ; ইহা তাদের অনুকরণে গঠিত। ভজন, গীতিকালে নৃত্য ও বেশভূষা নিরীক্ষন ইহাদিগকে বাতুল বলিয়া অনুমিত হয়।" প্রসিদ্ধ বাউল গবেষক ক্ষতিমোহন সেন মহাশয় বাউলদের 'পাগল-পারা' , 'বায়ুধর্মী' মানুষ বলে চিহ্নিত করেছেন।
তবে পোশাক-পরিচ্ছদ, জীবন-যাপন, আচার-আচরণ যতই বিচিত্র হোক না কেন এঁরা ভারতীয় ধর্মসাধনা সংস্কৃতির গভীর ঐতিহ্য সূত্রটি ধারণ করে আছে। বৈদিক ও অবৈদিক এবং লোকায়ত ভারতীয় ধর্মসংস্কৃতির অন্যতম প্রধান সাধনপন্থা 'সহজিয়া' বা 'সহজসাধনা' ; বাউলরা সেই সহজ সাধনপন্থার পথিক। বাউল সম্প্রদায়ের সাথে সহজিয়া বৌদ্ধধর্ম, সহজিয়া বৈষ্ণবধর্ম, মরমিয়া সূফিসাধনার আদর্শের গ্রহণ-বর্জনের গভীর যোগাযোগ লক্ষ করা যায়। দেহকে আশ্রয় করে দেহের মধ্যে পরমসত্ত্বার অনুভব করা হল সহজিয়া সাধনার প্রধান বৈশিষ্ট্য।
বাউল সম্প্রদায়ের মতেও দেহের মধ্যেই ব্রহ্মান্ডের সকল তত্ত্ব। এঁরা মনেকরে, যে নিজের শরীরকে চেনে তার মুক্তি অবশ্যম্ভাবী। তাই ঈশ্বর সাধনা প্রসঙ্গে লালন ফকির একসময় আক্ষেপ করে বলেছেন –
"আমি একদিনও না দেখিলাম তারে
আমার বাড়ির কাছে আরর্শী নগর এক পড়শী বসত করে। "
অর্থাৎ বৃথাই 'মনের মানুষকে' ( ঈশ্বরকে) বাইরে সন্ধান করা। তাকে বাইরে খুজলে পাওয়া যাবে না।
"এই মানুষে সেই মানুষ আছে। "
(লালন)
অর্থাৎ ঈশ্বর বাস করেন আপনার অন্তরে।
" আমার ঘরের চাবি পরের হাতে
কেমনে খুলিয়ে সে ধন দেখব চক্ষেতে।"
(লালন)
আপন ঘরের তালা খোলার চাবি নিজের কাছেই আছে। বাউল সম্প্রদায় সেই আপন ঘরের তালা খোলার সাধনা করে।
বাউল সাধকের পরিচয় নিলে বোঝা যায় এঁরা প্রেমর কাঙাল। এরা জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের বন্ধনমুক্ত ।
লালন ফকিরের কথায় –
"তাইতো বাউল হইনু ভাই
এখন বেদের ভেদ বিভেদের
আরতো দাবি দাওয়া নাই।।"
বাউল গান :বাউল সম্প্রদায়ের সাধনার গান বা সাধনসংগীত 'বাউল গান' নামে পরিচিত। বেশিরভাগ বাউলই ছিলেন ছিলেন নিরক্ষর, সমাজের একেবারে নিঁচুতলার মানুষ। গুরু-শিষ্য পরম্পরায়ই সাধনশিক্ষা করে গেছেন এঁরা । বাউলের কোন শাস্ত্র গ্রন্থ নেই –নেই কোন লিখিত পথ নির্দেশও। গানের মধ্যে দিয়েই তাদের সাধ্যসাধনার ইতিবৃত্ত উচ্চারিত হয়।
বাউল গানে পরিলক্ষিত হয় ভাষা-ছন্দ-অলঙ্কার ও সুরের সহজতা যা মূহুর্তেই মন জিতে নেয়। অথচ তার অন্তরালে লুকিয়ে আছে গাঢ় ধর্মতত্তের বানী। তাই সমালোচক যথার্থই বলেছেন "তারা তাদের মনের ভাব প্রকাশ করতে সে সকল উপমা রূপকের ব্যবহার করেছেন যে সকল একদিকে অতি সহজ, অন্যদিকে সেগুলি আশ্চর্যজনক ভাবে গুঢ়তাব্যঞ্জক।" বাউল যখন বলেন –
"খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আইসে যায়
তারে ধরতে পারলে মন বেড়ি দিতেম পাখির পায়।"
(লালন)
তখন এর গূঢ়ার্থ থেকে এর সহজ সুর কথার সরলতা সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করে। গভীর তত্ত্বের এমন সহজ সরল সংযত এবং সংহত প্রকাশ সত্যি বিরল। সহজিয়া বাউল গান এই সহজ স্বভাবের গুণই বিশ্বের দরবারে বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বাউল গানে মুগ্ধ হয়েছেন এবং তাদের সম্পর্কে লিখেছেন –
"দেখেছি একতার হাতে চলছে গানের ধারা বেয়ে
মনের মানুষ সন্ধান করবার
গভীর নির্জন পথে।"
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন